রাণুর প্রথম ভাগ ।

-বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 



 


বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় উপন্যাস

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প pdf

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় pdf

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প pdf download

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বরযাত্রী

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় জীবনী


বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (২৪ অক্টোবর ১৮৯৪ - ৩০ জুলাই ১৯৮৭)ছিলেন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। রসরচনায়ও রয়েছে তার অসামান্য দক্ষতা। তিনি অনেক কৌতুক ও রঙ্গরসের গল্পও লিখেছেন।


আমার ভাইঝি ব্রাণুর প্রথম ভাগের গণ্ডি পার হওয়া আর হইয়া উঠিল না ।

| তাহার সহস্রবিধ অন্তরায়ের মধ্যে দুইটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য — এক , তাহার প্রকৃতিগত অকালপক গিন্নিপনা , আর অন্যটি , তাহার আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষা । তাহার দৈনিক জীবনপ্রণালী লক্ষ করিলে মনে হয় , বিধাতা যদি তাহাকে একেবারে তাহার ঠাকুমার মতাে প্রবীণ গৃহিণী এবং কাকার মতাে এম . এ . , বি , এল , করিয়া পাঠাইতেন , তাহা হইলে তাহাকে মানাইতও ভালাে এবং সেও সন্তুষ্ট থাকিত । তাহার ত্রিশ - চল্লিশ বৎসর পরবর্তী ভাবী নারীত্ব হঠাৎ কেমন করিয়া যেন ত্রিশ - চল্লিশ বৎসর পূর্বে আসিয়া পড়িয়া তাহার ক্ষুদ্র শরীর - মনটিতে আর আঁটিয়া উঠিতেছে না — রাণুর । কার্যকলাপ দেখিলে এইরকমই একটা ধারণা মনে উপস্থিত হয় । প্রথমত , শিশুসুলভ সমস্ত ব্যাপারেই তাহারে ক্ষুদ্র নাসিকাটি তাচ্ছিল্যে কুঞ্চিত হইয়া উঠেখেলাঘর সে । মােটই বরদাস্ত করিতে পারে না , ফ্রক - জামাও না , এমনকি নােলকরাও নয় । মুখটা । গম্ভীর করিয়া বলে , আমার কি আর ও সবের বয়েস আছে মেজকা ? |

বলিতেতে হয় , না মা , আর ক — তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল । রাণু চতৃর্থকালের কাল্পনিক দুশ্চিন্তা - দুর্ভাবনায় মুখটা অন্ধকার করিয়া বসিয়া ।

 আর দ্বিতীয়ত — কতকটা বােধহয় শৈশবের সহিত সম্পর্কিত বলিয়াই — তাহার । ঘােরতর বিতৃষ্ণা প্রথম ভাগে । দ্বিতীয় ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার কাকার আইন - পুস্তক পর্যন্ত আর সবগুলির সহিতই তাহার বেশ সৌহার্দ্য আছে এবং তাহাদের । সহিতই তাহার দৈনিক জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়া যায় বটে , কিন্তু প্রথম ভাগের । নামেই সমস্ত উৎসাহ একেবারে শিথিল হইয়া আসে । বেচারির মলিন মুখখানি ভাবিয়া আমি মাঝে মাঝে এলাকাড়ি দিই — মনে করি , যাকগে বাপু , মেয়ে - নাই বা এখন । থেকে বই - মেট নিয়ে মুখ খুঁজরে রইল , ছেলে হওয়ার পাপটা তাে করেনি ; নেহাতই দরকার বােধ করা যায় , আর একটু বড় হােক , তখন দেখা যাবেখন । 


 এইরকমে দিনগুলা রাণুর বেশ যায় ; তাহার গিন্নিপনা সতেজে চলিতে থাকে এবং পড়াশুনরাও বিষম ধুম পড়িয়া যায় । বাড়ির নানা স্থানের অনেকসব বই হঠাৎ স্থানষ্ট হইয়া কোথায় যে অদৃশ্য হয় , তাহার যোজ দুরূহ হইয়া উঠে এবং উপরের ঘর , নিচের ঘর হইতে সময় - অসময়ে রাণুর উচু গলায় পড়ার আওয়াজ আসিতে থ্যকে — ঐ ক - য়ে য - ফলা ঐক্য , ম - য়ে আকার ণ - য়ে হই ক - য়ে য - ফলা মাণিক্য বা কার আইন মুখস্থ করে দিনগুলা বেশিদিন ঠাৎ পরিবর্তন হয় । ed গুরুমহাশয়ের বেগে পাখি সব করে রব রাতি পােহাইল , অথবা তাহার রাঙাকাকার আইন ঢঙে - হােয়ার অ্যাজ ইট ইজ , ইত্যাদি ।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প

 | আমার লাগে ভালাে , কিন্তু রাণুর স্বাভাবিক ঘূর্তির এইরকম দিন স্থায়ী হইতে পারে না । ভালাে লাগে বলিয়াই আমার মতির হঠাৎ পবি যায় এবং কর্তব্যজ্ঞানটা সমস্ত লঘুতাকে ভুভঙ্গি করিয়া প্রবীণ গুরুমহা আমার মধ্যে জাকিয়া আসিয়া বসে । সনাতন যুক্তির সাহায্যে হৃদয়ের সমস্ত নয় নিরাকরণ করিয়া গুরুগম্ভীর স্বরে ডাক দিই , ব্লাণু !

 রাণু এ সুরটি বিলক্ষণ চেনে ; উত্তর দেয় না । মুখটি কাঁদো - কাঁদো করিয়া অসহায় ভালােমানুষের মতাে ধীরে ধীরে আসিয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়ায় আওয়াজটা তাহার গলায় যেন একটা ফাস পরাইয়া টানিয়া আনিয়াছে , কর্তব্যবােধে আরও কড়া হইয়া উঠি , সংক্ষেপে বলি , প্রথম ভাগ । যাও । ।

 | ইহার পরে প্রতিবারই যদি নির্বিবাদে প্রথম ভাগটি আসিয়া পড়িত এবং যেনতে প্রকারেণ দুইটা শব্দুও গিলাইয়া দেওয়া যাইত তাে হাতেখড়ি হওয়া ইস্তক এই আড়াইটা বৎসর গেল , ইহার মধ্যে মেয়েটাও যে প্রথম ভাগের ও - কয়টা পাতা শেষ করিতে পারিত না , এমন নয় । কিন্তু আমার হুকুমটা ঠিকমতাে তামিল না হইয়া কতকগুলা জটিল ব্যাপারের সৃষ্টি করে মাত্র — যেমন এরূপ ক্ষেত্রে কোনও কোনও বার দুই - তিন দিন পর্যন্ত রাণুর টিকিটি আর দেখা যায় না । সে যে কোথায় গেল । কখন আহার করিল , কোথায় শয়ন করিল , তাহার একটা সঠিক খবর পাওয়া যায় । । দুই - তিন দিন পরে হঠাৎ যখন নজর পড়িল , তখন হয়তাে সে তাহার ঠাকুরদান । সঙ্গে চায়ের আয়ােজনে মাতিয়া গিয়াছে , কিংবা তাহার সামনে প্রথম ভাগটাই খুলি । রাখিয়া তাহার কাকাদের পড়ার খরচ পাঠানাে কিংবা আহার্যদ্রব্যের বর্তমান দল । প্রভৃতি সংসারের কোনও একটা দুরূহ বিষয় লইয়া প্রবল বেগে জ্যাঠামি করিয়া । যাইতেছে , অথবা তাহার বাগানের জোগাড়যন্ত্রের দক্ষিণহস্তস্বরূপ হইয়া সব বিষয়ে নিজের মন্তব্য দিতে দিতে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে । আমার দিকে হয়তাে একটু আড়চোখে চাহিল , বিশেষ কোনও ভয় বা উদবেগ নাই — জানে , এমন দুর্ভেদ্য দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে , যেখানে সে কিছুকাল সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন ।

| আমি হয়তাে বলিলাম , কই রাণু , তােমায় না তিন দিন হল বই আনতে বা হয়েছিল ?


 সে আমার দিকে না চাহিয়া বাবার দিকে চায় , এবং তিনিই উত্তর দেন ; যে , সে এক মহা মুশকিল ব্যাপার হয়েছে , ও বইটা যে কোথায় ফেলেছে রাণু চাপা স্বরে শুধরাইয়া দেয় , ফেলিনি — বলাে , কে যে চুরি করে নিয়েছে । হ্যা , কে যে চুরি করে নিয়েছে , বেচারি অনেকক্ষণ খুঁজেও রাণু জোগাইয়া দেয় , তিন দিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েও হ্যা , তােমার গিয়ে , তিন দিন হয়রান হয়েও — শােয়ে না পেয়ে হাল ছে ? রাণ ফিসফিস করিয়া বলিয়া দেয় , হাল ছাড়িনি এখনও ।
হ্যা , ওর নাম কী হাল না ছেড়ে ক্রমাগত মজে এজে বেড়াচ্ছে । যা হােক , একখানা বই আজ এনে দিও , কতই বা দাম ! রাগ ধরে , তুই বুঝি এই কাটারি হাতে করে বাগানে বাগানেই বই খুঁজে বেড়াচ্ছিস ? লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে ! কাতরতরে বাবা বলেন , আহা ওকে আর এ সামান্য ব্যাপারের জন্যে গালমন্দ করা কেন ? এবার থেকে ঠিক করে রাখবে তাে গিন্নি ? রাণু খুব ঠুকাইয়া ঘাড় নাড়ে । আমি ফিরিয়া আসিতে আসিতে শুনিতে পাই , তােমায় অত করে শেখাই , তবু একটুও মনে থাকে না না । কী যেন হচ্ছ দিন দিন ! কখনাে কখনাে কুম করিবার খানিক পরেই বইটার আধখানা আনিয়া হাজির করিয়া সে খােকার উপর প্রবল তম্বি আরম্ভ করিয়া দেয় । তম্বিটা আসলে আরম্ভ হয় আমাকেই ঠেস দিয়া , তােমার আদুরে ভাইপাের কাজ দ্যাখাে মেজকা । লােকে আর পড়াশােনা করবে কোথা থেকে ? ' আমি বুঝি , কাহার কাজ । কটমট করিয়া চাহিয়া থাকি । । দুষ্ট ছুটিয়া গিয়া বামালসুদ্ধ খােকাকে হাজির করে — সে বােধহয় তখন একখানা । পাতা মুখে পুরিয়াছে এবং বাকিগুলার কী করিলে সবচেয়ে সগতি হয় , সেই সম্বন্ধে । গবেষণা করিতেছে । তাহাকে আমার সামনে ধপ করিয়া বসাইয়া রাণু রাগ দেখাইয়া বলে , পেত্যয় না যাও , দ্যাখাে । আচ্ছা , এ ছেলের কখনও বিদ্যে হবে মেজকা ? ।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প

আমি তখন হয়তাে বলি , ওর কাজ , না তুমি নিজে ছিড়েছ রাণু ? ঠিক আগেকার । পাঁচখানি পাতা হেঁড়া - - যত বলি , তােমায় কিছু বলব না — খান তিরিশেক বই তাে । শেষ হল ! ধরা পড়িয়া লজ্জা , ভয় , অপমানে নিশ্চল , নির্বাক হইয়া এমনভাবে দাঁড়াইয়া । থাকে যে , নেহাত নৃশংস না হইলে ইহার উপর আর কিছু তাহাকে বলা যায় না । তখনকার মতাে শাস্তির কথা ভুলিয়া তাহার মনের গ্লানিটুকু মুছাইয়া দিবার জন্য । আমায় বলিতেই হয় , হারে দুষ্ট , দিদির বই ছিড়ে দিয়েছিস ? আর তুমিও তাে ওকে । একটু - আধটু শাসন করবে না রাণু । ওর আর কতটুকু বুদ্ধি , বলাে ? চাঁদমুখখানি হইতে মেঘটা সরিয়া গিয়া হাসি ফোটে । তখন আমাদের দুইজনের মধ্য হইতে প্রথম ভাগের ব্যবধানটা একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং রাণু দিব্য । সহজভাবে তাহার গিন্নিপনার ভূমিকা আরম্ভ করিয়া দেয় । এই সময়টা সে হঠাৎ এত । বড় হইয়া যায় যে , ছোট ভাইটি হইতে আরম্ভ করিয়া বাপ , বুড়া , ঠাকুরমা , এমনকি ঠাকুরদাদা পর্যন্ত সবাই তাহার কাছে নিতান্ত ক্ষুদ্র এবং স্নেহ ও করুণার পাত্র হইয়া পড়ে । এইরকম একটি প্রথম ভাগ হেঁড়ার দিনে কথাটা এইভাবে আরম্ভ হইল — কি করে শাসন করব বলল মেজকা ? আমার কি নিশ্বেস ফেলবার সময় আছে ; খালি কাজ — কাজ — আর কাজ ।

| হাসি পাইলেও গম্ভীর হইয়া বলিলাম , তা বটে , কত দিক আর দেখবে ? যে দিকটা না দেখেছি , সেই দিকেই গােল — এই তাে খােকার কাণ্ড চোখেই ।দেখলে । কেন রে বাপু , রাণু ছাড়া আর বাড়িতে কেউ নেই ? খাবার বেলা তাে অনেকগুলি মুখ , বললা মেজকা ! আচ্ছা , কাল তােমার ঝাল - তরকারিতে নুন ছিল ? বলিলাম , না , একেবারে মুখে দিতে পারিনি । তার হেতু হচ্ছে , রাণু কাল রান্নাঘরে যেতে পারেনি । — ফুরসত ছিল না । এই ততা সবার রান্নার ছিরি ! আজ আর সে রকম কম হবে না , আমি নিজের হাতে দিয়ে এসেছি নুন ।

 | আমার শখের ঝাল - তরকারি খাওয়া সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া মনের দুঃখ মনে চাপিয়া বলিলাম , তুমি যদি রােজ একবার করে দ্যাখাে মা । । গাল দুইটি অভিমানে ভারী হইয়া উঠিল , হবার জো নেই মেজকা , রাণু হয়েছে । বাড়ির আতঙ্ক । ওরে , ওই বুঝি রাণু ভাড়ারঘরে ঢুকেছে — রাণু বুঝি মেয়েটাকে টেনে দুধ খাওয়াতে বসেছে , দ্যাখাে দ্যাখাে - তােকে কে এত গিন্নিত্ব করতে বললে । বাপু ? ' হ্যা মেজকা , এত বড়টা হলুম , দেখেছ কখনও আমায় গিন্নিত্ব করতে কক্ষনাে — একরত্তিও ? বলিলাম , বলে দিলেই হল একটা কথা , ওদের আর কি । মুখটি বুজে শুনে যাই । একজন হয়তাে বললেন , ওই বুঝি রাণু রান্নাঘরে সেঁধােল ! ' রাঙি বেড়ালটা বলে , আমি পদে আছি । কেউ চেঁচিয়ে উঠলেন , ' ওরে , রাণু বুঝি ওর । বাপের ' আচ্ছা মেজকা , বাবার ফুলদানিটা আমি ভেঙেছি বলে তােমার একটুও । বিশ্বাস হয় ?

 | এই ঘটনাটি সবচেয়ে নুতন ; গিন্নিপনা করিয়া জল বদলাইতে গিয়া রাণই ফুলদানিটা । চরমার করিয়া দিয়াছে , ঘরে আর দ্বিতীয় কেহ ছিল না । আমি বলিলাম , কই , আমি । তাে মরে গেলেও একথা বিশ্বাস করতে পারি না । । ঠোট ফুলাইয়া রাণু বলিল , যার ঘটে একটুও বুদ্ধি আছে , সে করবে না । আমার কী দরকার মেজকা , ফুলদানিতে হাত দেবার ? কেন , আমার নিজের পেরথােম ভাগ । কি ছিল না যে , ফুলদানি ঘটতে যাব ? ।

 | প্রথম ভাগের উপর দরদ দেখিয়া ভয়ানক হাসি পাইল , চাপিয়া রাখিয়া বলিলাম , মিছিমিছি দোষ দেওয়া ওদের কেমন একটা রােগ হয়ে পড়েছে । | দুষ্ট একটু মুখ নিচু করিয়া চুপ করিয়া রহিল ; তাহার পর সুবিধা পাইয়া তাহার সদ্য দোষটুকু সম্পূর্ণরূপে স্বালন করিয়া লইবার জন্য আমার কোলে মুখ শুজিয়া আরও অভিমানের সুরে আস্তে আস্তে বলিল , তােমারও এ রোগটা একটু একট আছে মেজকা ; — এক্ষুনি বলছিলে , আমি পেরথেম ভাগটা ছিড়ে এনেছি । মেয়ের কাছে হারিয়া গিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার কেশের মধ্যে অঙ্গুলিসঞ্চালন করিতে লাগিলাম ।। ই হারানাে কী ছেড়া , পেট - কামড়ানাে , মাথাব্যথা , খােকাকে ধরা প্রভৃতি ব্যাপারগুলাে যখন অনেকদিন তাহাকে বাচাইবার পর নিতান্ত একঘেয়ে এবং শক্তিহীন হইয়া পড়ে , তখন দুই - এক দিনের জন্য নেহাত বাধ্য হইয়াই রাগ বই - সেট লইয়া হাজির হয় । অবশ্য পড়াশােনা কিছুই হয় না । প্রথমে গল্প জমাইবার চেষ্টা করে । সংসারের উপর কোনকিছুর জন্য মনটা ৰিচড়াইয়া থাকায় কিংবা অন্য কোনও কারণে যদি সকলের নিজ নিজ কর্তব্য সম্বন্ধে আমার মনটা বেশি রকম সজাগ থাকে তাে ধমক খাইয়া বই খােলে ; তাহার পর পড়া আরম্ভ হয় । সেটা রাণুর পাঠাভ্যাস , কী আমার ধৈর্য , বাৎসল্য , সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সগুণের পরীক্ষা , তাহা স্থির করিয়া বলা কঠিন । আড়াইটি বৎসর গিয়াছে , ইহার মধ্যে রাণু অজ ’ , আম ’ - এর পাতা শেষ করিয়া অচল ’ , ‘ অধম ' এর পাতায় আসিয়া অচলা হইয়া বসিয়া আছে । বই খুলিয়া আমার দিকে চায় অর্থাৎ বলিয়া দিতে হইবে । আমি প্রায়ই পড়াশােনার অত্যাবশ্যকতা সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র উপদেশ দিয়া আরম্ভ করি , আচ্ছা রাণ , যদি পড়াশােনা না করাে তাে বিয়ে । হলেই যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে , মেজকাকী রকম আছে , তাকে কেউ সকালবেলা চা দিয়ে যায় কিনা , নাইবার সময় কাপড় - গামছা দিয়ে যায় কিনা , অসুখ হলে কেউ । মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিনা — এসব কী করে খোঁজ নেবে ? রাণু তাহার মেজকাকার ভাবী দুর্দশার কথা কল্পনা করিয়া একটু মৌন থাকে , কিন্তু বােধহয় প্রথমভাগ - পারাবার পার হইবার কোনও সম্ভাবনাই না দেখিয়া বলে , আচ্ছা , মেজকা , একেবারে দ্বিতীয় ভাগ পড়লে হয় না । আমায় একটুও বলে দিতে । হবে না । এই শােনন না — ঐ ক - য়ে য - ফলা । রাগিয়া বলি , ওই ডেপােমি ছাড়াে দিকিন , ওইজন্যেই তােমার কিছু হয় না । নাও , পড়ে । সেদিন কত দূর হয়েছিল ? ‘ অচল ’ , ‘ অধম ’ শেষ করেছিলে ? ' রাণু নিষ্পভভাবে ঘাড় নাড়িয়া জানায় , হাঁ । বলি , পড়াে তাহলে একবার । ‘ অচল ' কথাটার উপর কচি আলটি দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে । আমার মাথার রক্ত গরম হইয়া উঠিতে থাকে এবং স্নেহ - করুণা প্রভৃতি স্নিগ্ধ চিত্তবৃত্তিগুলা । বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাইবার উপক্রম হয় । মেজাজেরই বা আর দোষ দিই কী করিয়া ? আজ এক বৎসর ধরিয়া এই ‘ অচল ’ , ‘ অধম লইয়া কসরত চলিতেছে ; এখনও রােজই এই অবস্থা ।


বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প রাণুর প্রথম ভাগ
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প রাণুর প্রথম ভাগ


| তবুও ক্রোধ দমন করিয়া গম্ভীরভাবে বলি , ছাই হয়েছে । আচ্ছা বলােত , চ — আর ল — অচল । । | রাণু অ ' র উপর হইতে আঙুলটা না সরাইয়া তিনটা অক্ষর পড়িয়া যায় । “ অধম ' - ও ওইভাবেই শেষ হয় ; অথচ ঝাড়া দেড়টি বৎসর শুধু অক্ষর চেনায় গিয়াছিল ।

তখন জিল্লাসা করিতে হয় , কোনটা ? রাণু ভীতভাবে আমার দিকে চাহিয়া আঙুলটি সরাইয়া ল - এর উপরে রাখে । ধৈর্যের সূত্রটা তখনও ধরিয়া থাকি , বলি , ই , কোনটা ল হল তাহলে ? আঙুলটা সট করিয়া চ - এর উপর সরিয়া যায় । ধৈর্যসাধনা তখনও চলিতে থাকে ; শাস্তকণ্ঠে বলি , চমৎকার । আর চ ? | খানিকক্ষণ স্থিরভাবে বইয়ের দিকে চাহিয়া থাকে , তাহার পর বলে , চ ? চ নেই মেজকা । সংযত রাগটা অত্যন্ত উগ্রভাবেই বাহির হইয়া পড়ে , পিঠে একটা চাপড় কষাইয়া বলি , তা থাকবে কেন ? তােমার ডেপােমি দেখে চম্পট দিয়েছে । হতভাগা মেয়ে রাজ্যের কথার জাহাজ হয়েছেন , আর এদিকে আড়াই বৎসরে প্রথম ভাগের আড়াইটে কথা শেষ করতে পারলে না ! কত বুড়াে বুড়াে গাধা ঠেঙিয়ে পাস করিয়ে দিলাম আর এই একরত্তি মেয়ের কাছে আমায় হার মানতে হল ! কাজ নেই তাের অক্ষর চিনে । সন্ধে পর্যন্ত বসে বসে খালি অ — — আর ল — অচল ; অধ — আর ম অধম — এই আওড়াবি । তাের সমস্ত দিন আজ খাওয়া বন্ধ । বিরক্তভাবে একটা খবরের কাগজ কিংবা বই লইয়া বসিয়া যাই ; রাণু ক্রন্দনের সহিত সুর মিশাইয়া পড়া বলিয়া যায় । । বলি বটে , সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়িতে হইবে ; কিন্তু চড়টা বসাইয়াই নিশ্চিন্ত হইয়াই যাই । যে , সেদিনকার পড়া ওই পর্যন্ত । রাণু এতক্ষণ চক্ষের জলের ভরসাতেই থাকে এবং অশ্রু নামিলেই সেটাকে খুব বিচক্ষণতার সহিত কাজে লাগায় । কিছুক্ষণ পরে আর পড়ার আওয়াজ পাই না ; বলি , কী হল ? রাণু ক্রন্দনের স্বরে উত্তর করে , নেই । কী নেই ? — বলিয়া ফিরিয়া দেখি , চক্ষের জল ‘ অচল ’ , ‘ অধম ' - এর উপর ফেলিয়া আঙুল দিয়া ঘষিয়া কথা দুইটা বিলকুল উড়াইয়া দিয়াছে — একেবারে নিচের দুই তিনখানা পাতার খানিকটা পর্যন্ত । | কিংবা আঙুলের ডগায় চোখের ভিজা কাজল লইয়া কথা দুইটিকে চিরন্ধকারে ডুবাইয়া দিয়াছে ; এইরূপ অবস্থাতে বলে , আর দেখতে পাচ্ছি না , মেজা । — এইরকম আরও সব কাণ্ড । | চড়টা মারা পর্যন্ত মনটা খারাপ হইয়া থাকে , তাহা ভিন্ন ওর ধর্তামি দেখিয়া হাসিও পায় । মেয়েদের পড়াশোনা সম্বন্ধে আমার থিওরিটা ফিরিয়া আসে , বলি না । তাের আর পড়াশুনা হল না রাণু , স্লেটটা নিয়ে আয় দিনি — দেখে ও পিঠটায় লেগেছে বেশি ? দেখি ? | রাণু বুঝিতে পারে , তাহার জয় আরম্ভ হইয়াছে , এখন তাহার সব কথাই চলিবে । আমার বঁধটা জড়াইয়া আস্তে আস্তে ডাকে , মেজকা ! উত্তর দিই , কী ? আমি , মেজকা , বড় হইনি ?

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প

এ তাে খুব হয়েছ , কিন্তু কই , বড়র মতন xx দিয়ে বলে , তাহলে স্লেট ছেড়ে ছােটকাকার মতাে কাগজ - পেনসিল নিয়ে : চারটে উটপেনসিল আছে আমার । স্লেটে খােকা বড় হয়ে লিখবেশন । হঠাৎ রিয়া উঠিয়া বলে , ও মেজকা , তােমার দুটো পাকা চুল গৈ । সর্বনাশ ! বেছে আসব ? চারটে বলি , দাও । আচ্ছা রাণু , এই তাে বুড়াে হতে চললাম , তুইও দুদিন পরে শ্বশুরবাড়ি র । লেখাপড়া শিখলিনি , মরলাম কী বাঁচলাম , কী করে খোঁজ নিবি ? আমায় কেউ খে - শােনে কিনা , বেঁধে - টেধে দেয় কিনা বাণ বলে , পড়তে তাে জানি মেজকা , খালি পেরথেম ভাগটাই জানি না , বড় রেছি কিনা । বাড়ির আর কোন লােকটা পেরথেম ভাগ পড়ে মেজকা , দেখাও তাে ! দাদা ওদিকে ধর্ম সম্বন্ধে খুব লিবারেল মতের লােক ছিলেন , অর্থাৎ হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞতাটা যেন গভীর করিয়া রাখিয়াছিলেন , খ্রিস্ট এবং কবেকার জরাজীর্ণ জুরুয়াছিয়ানবাদ সম্বন্ধে জ্ঞানটা সেইরূপ উচ্চ ছিল । দরকার হইলে বাইবেল হইতে সুদীর্ঘ কোটেশন তলিয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়া দিতে পারিতেন এবং দরকার না হইলেও যখন একধার হইতে সমস্ত ধর্মমত সম্বন্ধে সুতীব্র সমালােচনা করিয়া ধর্মমত মাত্রেরই । অসারতা সম্বন্ধে অধার্মিক ভাষায় ভূরিভূরি প্রমাণ দিয়া যাইতেন , তখন ভক্তদের । বলিতে হইতাে , হ্যা , এখানে খাতির চলবে না বাবা , এ যার নাম শশাঙ্ক মুখুজে । দাদা বলিতেন , না , গোড়ামিকে আমি প্রশ্রয় দিতে মােটেই রাজি নই । । প্রায় সব ধর্মবাদকেই তিনি গোঁড়ামি ' নামে অভিহিত করিতেন এবং গালাগাল । না দেওয়াকে কহিতেন ‘ প্রশ্রয় দেওয়া । সেই দাদা এখন একেবারে অন্য মানুষ । ত্রিসন্ধ্যা না করিয়া জল খান না এবং । জলের অতিরিক্ত যে বেশি কিছু খান বলিয়া বােধ হয় না । পূজাপাঠ , হােম লইয়াই । আছেন এবং বাক ও কর্মে শুচিতা সম্বন্ধে এমন একটা গেল গেল ’ ভাব যে , । আমাদের তাে প্রাণ যায় যায় হইয়া উঠিয়াছে । | ভক্তেরা বলে , ওরকম হবে , এ তাে জানা কথাই , এই হচ্ছে স্বাভাবিক বিবর্তন ; একেবারে খাটি জিনিসে দাঁড়িয়েছে । সকলের চেয়ে চিন্তার বিষয় হইয়াছে যে , এই অসহায় লাঞ্ছিত হিন্দুধর্মের জন্য একটা বড় রকম ত্যাগ স্বীকার করিবার নিমিত্ত দাদা নিরতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন এবং হাতের কাছে আর তেমন কিছু আপাতত না পাওয়ায় ঝোকটা গিয়া পড়িয়াছে ছােট কন্যাটির উপর । । একদিন বলিলেন , ওহে শৈলেন , একটা কথা ভাবছি , ভাবছি বলি কেন , এক রকম স্থির করে ফেলেছি । মুখে গম্ভীর তেজস্বিতার ভাব দেখিয়া সভয়ে প্রশ্ন করিলাম , কী দাদা ?

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প রাণুর প্রথম ভাগ


গৌরীদান করব স্থির করেছি , তােমার রাণুর কত বয়স হল ? বয়স না বলিয়া বিস্মিতভারে বললাম , সে কী দাদা ! এযুগে দাদা সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন , যুগের ‘ এ ’ আর ‘ সে ’ নেই শৈলেন । ওইখানেই তােমরা ভুল করাে । কাল এক অনন্তব্যাপী অখণ্ড সভা এবং যে শুদ্ধ সনাতনধর্ম সেই কালকে একটু অস্থির হইয়া বলিলাম , কিন্তু দাদা , ও যে এখনও দুগ্ধপােষ্য শিশু । দাদা বলিলেন , এবং শিশুই থাকবে ও , যতদিন তােমরা বিবাহবন্ধনের দ্বারা ওর আবার সংস্কার ও পূর্ণ বিকাশের অবসর করে না দিচ্ছ । এটা তােমায় বােঝাতে হলে আগে আমাদের শাস্ত্রকাররা | অসহিষ্ণুভাবে বলিলাম , সে তাে বুঝলাম কিন্তু ওর তাে এই সবে আট বছর পেরুল দাদা , ওর শরীরই বা কতটুকু আর তার মধ্যে ওর আত্মাই বা কোথায় , তা তাে বুঝতে পারি না । আমার কথা হচ্ছে | দাদা সেদিকে মন না দিয়া নিরাশভাবে বলিলেন , আট বৎসর পেরিয়ে গেছে । তা হলে আর কই হল শৈলেন ? মনু বলেছেন , অষ্টবর্ষা ভবেদগৌরী নববর্বে তুরােহিণী ’ জানি , অতবড় পুণ্যকর্ম কি আমার হাত দিয়ে সমাধান হবে ! ছােটটার বয়স কত হল ? | রাণুর ছােট রেখা পাঁচ বৎসরের । দাদা বয়স শুনিয়া মুখটা কুঞ্চিত করিয়া একট । মৌন রহিলেন । পাঁচ বৎসরের কন্যাদের জন্য কোনও একটা পুণ্যফলের ব্যবস্থা না । করিয়া যাওয়ার জন্য মনুর উপরেই চটিলেন , কিংবা অতি পিছাইয়া জন্ম লওয়ার । জন্য রেখার উপরই বিরক্ত হইলেন , বুঝিতে পারিলাম না । কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে স্থান ত্যাগ করিলেন । আমিও আমার রুদ্ধশ্বাসটা মােন করিলাম । মনে মনে কহিলাম , যাক , মেয়েটার একটা ফাড়া গেল । | দুই দিন পরে দাদা ডাকিয়া পাঠাইলেন । উপস্থিত হইলে বলিলেন , আমি ও সমস্যাটুর এক রকম সমাধান করে ফেলেছি শৈলেন । অর্থাৎ তােমার রাণুর বিবাহের । কথাটা আর কী । ভেবে দেখলাম , যুগধর্মটা একটু বজায় রেখে চলাই ভালাে বইকি — আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাছিলাম , হর্যের সহিত বলিলাম , নিশ্চয় , শিক্ষিত সমাজে । কোথায় বােলাে - সতেরাে বছরে বিবাহ চলছে দাদা , এসময় একটা কচি মেয়েকে । যার ন বছরও পুরাে হয়নি — তা ভিন্ন খাটো গড়ন বলে । | ঝাটা মারাে তােমার শিক্ষিত সমাজকে । আমি সে কথা বলছি না । বলছিলাম যে , যদি এই সময়ই রাণুর বিয়ে দিই , তা মন্দ কী ? বেশ তাে যুগধর্মটাও বজায় রইল , অথচ ওদিকে গৌরীদানেরও খুব কাছাকাছি রইল । ক্ষতি কী ? এটা হবে , যাকে বলতে পারা যায় মডিফায়েড গৌরীদান আর কী । । | আমি একেবারে থ হইয়া গেলাম । কী করিয়া দাদাকে বুঝাইব , কিছুই ঠিক করিতে পারিলাম না । দাদা বলিলেন , পণ্ডিতমশায়েরও মত আছে । তিনি অনেক ঘাটাঘাটি করে দেখে বললেন , কলিতে এইটিই গৌরীদনের সমফলপ্রসূ হবে ।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প রাণুর প্রথম ভাগ


  আমি দুঃখ ও রাগ মিটাইবার একটা আধার পাইয়া একটু উষ্মর সহিত বলিলাম , পণ্ডিতমশায় তাহলে একটা নিছক মিথ্যা কথা আপনাকে বলেছেন দাদা , আপনি সন্তুষ্ট হলে উনি একথাও বােধহয় শাস্ত্র ঘেঁটেই বলে দেবেন যে , মেয়েকে হাত - পা বেধে জলে ফেলে দিলেও আজকাল গৌরীদানের ফল হবার কথা । কলিযুগটা তাে ওদের কল্পবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে , যখন যে বিধানটি চাইবেন , পাকা ফলের মতাে টুপ করে হাতে এসে পড়বে । | দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম । আমিই কথা কহিলাম , যাক , ওঁরা বিধান দেন , দিন বিয়ে । আমি এখন আসি , একটু কাজ আছে । | আসিবার সময় ঘুরিয়া বলিলাম , হ্যা , শরীরটা খারাপ বলে ভাবছি , মাস চারেক একটু পশ্চিমে গিয়ে কাটাব ; হপ্তাখানেকের মধ্যে বােধহয় বেরিয়ে পড়তে পারব বলিয়া চলিয়া আসিলাম । | ৪ । অভিমানের সাহায্যে ব্যাপারটা মাস তিন - চার কোনও রকমে ঠেকাইয়া রাখিলাম , । কিন্তু তাহার পর দাদা নিজেই এমন অভিমান শুরু করিয়া দিলেন যে , আমারই হার মানিতে হইল । ধর্মের পথে অন্তরায় হইবার বয়স এবং শক্তি বাবার তাে ছিলই না , তবুও নাতনির মায়ায় তিনি দোমনা হইয়া কিছুদিন আমার পক্ষে রহিলেন , তারপর মেক্রমে ওই দিকেই ঢলিয়া পড়িলেন । আমি বেখাপ্পা রকম একলা পুড়িয়া গিয়া । একটা মস্ত বড় ধর্মদ্রোহীর মতাে বিরাজ করিতে লাগিলাম । । | রাণুকে ঢালােয়া ছুটি দিয়া দিয়াছি । মায়াবিনী অচিরেই আমাদের পর হইবে । বলিয়া যেন ক্ষুদ্র বুকখানির সমস্তটুকু দিয়া আমাদের সংসারটি জড়াইয়া ধরিয়াছে । । পারুক , না পারুক — সে সমস্ত কাজেই আছে এবং যেটা ঠিকমতাে পারে না , সেটার । জন্য এমন একটা সংকোচ এবং বেদনা আজকাল তাহার দেখিতে পাই , তাহাতে সত্যই মনে হয় , নকলের মধ্য দিয়ে মেয়েটার একবার আসল গৃহিণীপনার ছোঁয়াচ । লাগিয়াছে । অসহায় মেজকাকাটি তাে চিরদিনই তাহার একটা বিশেষ পােষ্য ছিলই । আজকাল আবার প্রথমভাগ - বিবর্জিত সুপ্রচুর অবসরের দরুন একেবারে তাহার কোলের শিশুটিই হইয়া পড়িয়াছে বলিলে চলে । | সময় সময় গল্প হয় : আজকাল বিয়ের গল্পটা হয় বেশি । অন্যের সঙ্গে এবিষয় লইয়া আলােচনা করিতে রাণু ইদানীং লজ্জা পায় বটে , কিন্তু আমার কাছে কোনও দ্বিধা - কুণ্ঠাই আসিবার অবসর পায় না ; তাহার কারণ আমাদের দুইজনের মধ্যে সমস্ত মুত্ব বাদ দিয়া গুরুগম্ভীর সমস্যাবলির আলােচনা চলিতে থাকে । বলি , তা নয় হল Fণু তুমি মাসে দুবার করে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে আমাদের সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে গেলে , আর সবই করলে , কিন্তু তােমার মেজকাকাটির কী বন্দোবস্ত করছ ? রাণু বিমর্য হইয়া ভাবে : বলে , আমরা সব বলে বলে তাে হায়রান হয়ে গেলাম মেজকা যে , বিয়ে করাে , বিয়ে করাে । তা শুনলে গরিবদের কথা ? রাণু কি তােমায় চিরদিনটা দেখতে - শুনতে পাররে মেজকা ? এর পরে তার নিজের ছেলেপুলেও মান । করতে হবে তাে । মেয়ে আর কতদিন নিজের বলাে ? | তােতাপাখির মতাে কচি মুখে বুড়ােদের কাছে শেখা বুলি শুনিয়া হাসির কা কাদিব , ঠিক করিতে পারি না , বলি , আচ্ছা একটা গিন্নিবান্নি কনে দেশে এখনও বিয়ে করলে চলে না ? কী বলাে তুমি ? | এই বাঁধা কথাটি তাহার ভাবী শ্বশুরবাড়ি লইয়া একটি ঠাট্টার উপক্রমণিকা । রাণ কৃত্রিম অভিমানের সহিত হাসি মিশাইয়া বলে , যাও মেজকা , আর গল্প করব না ; তুমি ঠাট্টা করছ । | আমি চোখ পাকাইয়া বিপুল গাম্ভীর্যের সহিত বলি , মােটেই ঠাট্টা নয় , রাণ , তােমার শাশুড়িটি বড় গিন্নি শুনেছি , তাই বলছিলাম , যদি বিয়েই করতে হয় রাণু আমার দিকে রাগ করিয়া চায় , গম্ভীর হইয়া চায় এবং শেষে হাসিয়া চায় । কিছুতেই যখন আমার মুখের অটল গাম্ভীর্য বদলায় না , তখন প্রতারিত হইয়া গুরুতে । সহিত বলে , আচ্ছা , আমি তাহলে — না মেজকা , নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ যাও , | আমি চোখ আরও বিস্ফারিত করিয়া বলি , একটুও ঠাট্টা নেই এর মধ্যে রাণ , সব কথা নিয়ে কি আর ঠাট্টা চলে মা ? | রাণু তখন ভারিক্কে হইয়া বলে , আচ্ছা , তাহলে আমার শাশুড়ীকে একবার বলে দেখবখন , আগে যাই সেখানে । তিনি যদি তােমায় বিয়ে করতে রাজি হন তাে । তােমায় জানাব ’ খন ; তার জন্যে ভাবতে হবে না । তাহার পয় কৌতুকদীপ্ত চোখে । চাহিয়া বলে , আচ্ছা মেজকা পেরথােম ভাগ তাে শিখিনি এখনও — কী করে তােমায় জানাব বল দিকিন , তবে বুঝব , হা | আমি নানান রকম আন্দাজ করি ; বিজয়িনী ঝাকড়া মাথা দুলাইয়া হাসিয়া বলে , , হল না — কননা বলতে পারবে না , সে বড় শক্ত কথা । | এইসব হাসিতামাশা , গল্পগুজব হঠাৎ মাঝখানে শেষ হইয়া যায় ; রাণু চঞ্চলতার মাঝে হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলে , যাক সে পরের কথা পরে হবে ; যাই , তােমার চা হল কিনা দেখিগে । কিংবা — যাই , গল্প করলেই চলবে না , তােমার লেখার টেবিলটা আজ গুছােতে হবে , একডাই হয়ে রয়েছে — ইত্যাদি । । | এইরকমভাবে রাণুকে নিবিড় হইতে নিবিড়তরভাবে আমার বুকের মধ্যে আনিয়া দিতে দিতে বিচ্ছেদের দিনটা আগাইয়া আসিতেছে । | বুঝি না রাণুর বুকটিতেও এই আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনা তাহার অগােচরে একটু একটু করিয়া ঘনাইয়া উঠিতেছে । কচি সে , বুঝিতে পারে না ; কিন্তু যখনই আজকাল ছুটি পাইলে নিজের মনেই স্লেট ও প্রথম ভাগটা লইয়া হাজির হয় , তখনই বুঝিতে পারি , এ আগ্রহটা তাহার কাকাকে সান্ত্বনা দেওয়ারই একটা নূতন রূপ ; কেননা , প্রথম ভাগ শেখার আর কোনও উদ্দেশ্য থাক আর না থাক , ইহার উপরই ভবিষ্যতে তাহার কাকার সমস্ত সুখ - সুবিধা নির্ভর করিতেছে রাণুর মনে এ ধারণাটুকু বন্ধ লইয়া গিয়াছে । এখন আর একেবারেই উপায় নাই বলিয়া তাহার শিশুমনটি ব্যথায়

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প

বিয়া উঠে ; প্রবীণার মতো আমায় তবুও আশ্বাস দেয় , তুমি ভেবাে না মেজকা , তোমার পেরথম ভাগ না শেষ করে আমি কক্ষনাে শ্বশুরবাড়ি যাব না । নাও , বলে দাও । | পড়া অবশ্য এগােয় না । বলিয়া দিব কি , প্রথম ভাগটা দেখিলেই বুকে যেন কান্না বলিয়া উঠে । ওদিকে আবার প্রতিদিনই গৌরীদানের বর্ধমান আয়ােজন । বাড়ির বাতাসে আমার হাঁফ ধরিয়া উঠে । এক - একদিন মেয়েটাকে বুকে চাপিয়া ধরি , বলি , আমাদের কোন দোষে তুই এত শিগগির পর হতে চললি রাণ ? | বােঝে না , শুধু আমার ব্যথিত মুখের দিকে চায় । এক - একদিন অবকভাবেই ঈদ কাদ হইয়া উঠে ; এক - একদিন জোর গলায় প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে , তােমার কষ্ট হয় তাে বিয়ে এখন করবই না মেজকা , বাবাকে বুঝিয়ে বলব ’ খন । । | একদিন এই রকম প্রতিজ্ঞার মাঝখানেই সানাইয়ের করুণ সুর বাতাসে ক্রন্দনের লহর তুলিয়া বাজিয়া উঠিল । রাণু কুষ্ঠিত আনন্দে আমার মুখের দিকে চাহিয়া হঠাৎ । কী রকম হইয়া গিয়া মুখটা নিচু করিল ; বােধ করি , তাহার মেজকাকার মুখে । বিষাদের ছায়াটা নিতান্তই নিবিড় হইয়া তখন ফুটিয়া উঠিয়াছিল । গৌরীদান শেষ হইয়া গিয়াছে ; আমাদের গৌরীর আজ বিদায়ের দিন । আমি । শুভকর্মে যােগদান করিয়া পূণ্যসঞ্চয় করিতে পারি নাই , এ বাড়ি সে বাড়ি করিয়া বেড়াইয়াছি । বিদায়ের সময় বরবধূকে আশীর্বাদ করিতে আসিলাম । । দীপ্তশ্রী কিশাের বরের পাশে পট্টবস্তু ও অলংকার পর , মালাচন্দনে চর্চিত রাণকে । দেখিয়া আমার তপ্ত চকু দুইটা যেন জুড়াইয়া গেল । কিন্তু ও যে বডড কচি , এত । সকালে কী করিয়া বিদায়ের কথা মুখ দিয়া বাহির করা যায় ? ও কি জানে , আজ । কতই পর করিয়া ওকে বিদায় দিতেছি আমরা ? | চক্ষে কোচার ফুট দিয়া পুণ্যদর্শন শিশুদম্পতিকে আশীর্বাদ করিলাম । রানুর চিবুকটা তুলিয়া প্রশ্ন করিলাম , রাণু তাের এই কোলের ছেলেটাকে তার কাছে ? আর বলিতে পারিলাম না । | রাণ শুনিয়াছি এতক্ষণ কাঁদে নাই । তাহার কারণ নিশ্চয়ই এই যে , সংসারের প্রবেশ - পথে দাড়াইতেই ওর অসময়ের গৃহিণীপনাটা সরিয়া গিয়া ওর মধ্যকার শিশুটি বিস্ময়ে কৌতুহলে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল । আমার কথার আভাসে সেই শিশুটিই নিজের অসহায়তায় আকুল হইয়া পড়িল । আমার বাহুতে মুখ লুকাইয়া রাণ উচ্ছসিত আবেগে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিয়া উঠিল । কখনও কচি মেয়ের মতাে ওকে ভলাইতে হয় নাই । আমার খেলাঘরের মা হইয়া ওই এতদিন আমার আদর করিয়াছে আশ্বাস দিয়াছে ; সেইটাই আমাদের সম্বন্ধের মধ্যে যেন সহজ এবং স্বাভাবিক হইয়া scয়ন ভালাে মানাইত । আজ প্রথম ওকে বুকে চাপিয়া সান্ত্বনা দিলাম — যেমন দধের ছেলে মেয়েকে শান্ত করে - বুঝাইয়া , মিথ্যা কহিয় ! , কত প্রলােভন দিয়া । । কে নিতে চায় ? ওর সব হাসির অন্তরালে এতদিন যে গোপনে শুধ । অই সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল ।
অনেক ফোপাইয়া ফেঁপাইয়া সে থামিল । অভ্যাসমততা আমার করতল দিয়াই নিজের মুখটা মুছাইয়া লইল ; তাহার পর হাতটাতে একটু দান দিয়া আস্তে আস্তে বলিল , এদিকে এসাে , শােনাে মেজকা । । | দুইজনে একটু সরিয়া গেলাম । সকলে এই অসম মাতাপুত্রের অভিনয়ের দিকে চাহিয়া রহিল । রাণু বুরে কাছ হইতে তাহার প্রচুর বস্ত্রের মধ্য হইতে লাল ফিতার যত্ন করিয়া । বাঁধা দশ - বারােখানি প্রথম ভাগের একটা বান্ডিল বাহির করিল , অশ্রুসিক্ত মুখখানি । আমার মুখের দিকে তুলিয়া বলিল , পেরথেম ভাগগুলাে হারাই নি মেজকা , আমি দুষ্ট । হয়েছিলুম , মিছে কথা বলতুম । গলা ভাঙিয়া পড়ায় একটু থামিল , আবার বলিল , সবগুলাে নিয়ে যাচ্ছি মেজকা , । – লক্ষ্মী হয়ে পড়ে পড়ে এবার শিখে ফেলব । তারপরে তােমায় রােজ চিঠি । লিখব । তুমি কিছু ভেবাে না মেকা ।

Download here...

Post a Comment

Previous Post Next Post