হাত বাড়াও

_ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়
হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

 শীতকালে শুধু পায়ের পাতাটুকু ডােবে এমন নদী তিস্তা। হেঁটে পার হবার সময় পেছনে যদি তাকাও দেখবে আকাশের পিঠে পিঠ রেখে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রকাণ্ড এক দৈত্য । আসলে দৈত্য নয় , হিমালয় পাহাড় ।


 নন্দীগ্রামের এক অখ্যাত গাঁয়ে মােনা - লাগা তালগাছের বন পেরিয়ে আকাশের কোলের কাছে প্রথমে ছােট্ট একটা ফোটা , তারপর আস্তে আস্তে তালগাছের মতাে বড়াে হয়ে উঠল । কী ওটা ? আগন্তুক এক জাহাজের মাস্তুল । আর সামনের বালিয়াড়ি পেরিয়ে ধু ধু করে উঠল । নীল সমুদ্র । বঙ্গোপসাগর ।

হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

 এই আসমুদ্রহিমাচল আমার বাংলা পর্বত যার প্রহরী , সমুদ্র যার পরিখা । 


ফরিদপুরের গাড়ি আসতে তখনও অনেক দেরি । রাজবাড়ির বাজারে বসে আছি । পাতলা কুয়াশায় মােড়া পঞ্চাশের আকালের এক সকাল । একটু দূরে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে একটা অদ্ভুত জন্তু দেখলাম । আস্তে আস্তে চার পায়ে এগিয়ে আসছে । চেনা কোনাে জন্তুর সঙ্গে তার মিল নেই । কুয়াশার মধ্যেও জ্বল জ্বল করছে তার দুটো চোখ । একা থাকলে ভয়ে মূছা যেতাম । কেননা সেই চোখের দৃষ্টিতে এমন এক মায়া ছিল , যা বুকের রক্ত হিম করে দেয় ।


 আরও কাছে এগিয়ে এল সেই মূর্তি । রাস্তার ধুলাে থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে । তার জ্বলন্ত দুটো চোখ কুয়াশায় কী যেন খুঁজে খুঁজে ফিরছে । ঠিক , মানুষের হাতের মতাে তার সামনের দুটো থাবা । আঙুলগুলাে যেন আগার দিকে একটু বেশি সরু । গায়ে একটুও লােম নেই । কোন্ জন্তু ?

হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়


হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়
হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়


 সামনাসামনি আসতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । অমৃতের পুত্র মানুষ । বারাে - তেরাে বছরের উলঙ্গ এক ছেলে । মাজা পড়ে গেছে । হাঁটতে পারে না । তাই জানােয়ারের মতাে চার পায়ে চলে । বাজারের রাস্তায় খুঁটে খুঁটে খায় চাল আর ছােলা ।


 ছুটে পালিয়ে এলাম স্টেশনে । কিন্তু আজও সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে।দু - হাতে সােনা ছড়ানাে নদীমালার দিকে তাকিয়ে তার নিশ্বাস শুনি । সরুলিকলিকে আঙুল দিয়ে সেইসব খুনীদের সে শনাক্ত করছে — শহরে গ্রামে বন্দরে গঞ্জে জীবনের গলায় যারা মৃত্যুর ফাস পরাচ্ছে , মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিচ্ছে না যারা মানুষকে ।


হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়


সেই দুটি জ্বলন্ত চোখ শান্তি চায় । বাংলার বুক জুড়ে সবুজ মাঠের সােনালি ফসলে , চাষির গােলাভরা ধানে ভরে উঠুক শান্তি । কারখানায় কারখানায় বন্ধনমুক্ত মানুষের আন্দোলিত বাহুতে বাহু মেলাক শান্তি । যুদ্ধ নয় , অনাহারে মৃত্যু নয় আর । কোটি কোটি বলিষ্ঠ হাতে এবার স্বাধীন সুখী জীবন , এবার শান্তি । 


যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের ঘনায়মান অন্ধকারে দুটি জ্বলন্ত চোখ জেগে আসমুদ্রহিমাচল এই বাংলায় পাহারা দিচ্ছে আর মাটি থেকে দুটো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দু - পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে । সে । তােমরাও হাত বাড়াও , তাকে সাহায্য করাে ।


হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়
হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহির নওগাঁয় যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুভাষের শৈশব কেটেছিল । কলকাতায় । ৫০ নম্বর নেবুতর গলিতে । আবার কলকাতায় ফিরে মেজোকাকার বাসায় , বাহরাম । লেখক পরিচিতি কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের জন্ম নদিয়ার কৃষ্ণনগরে , ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি । তকুর লেনে আশ্রয় নিলেন । ভরতি হলেন ক্লাস ফাইভে । মেট্রোপলিটান স্কুলে , বউবাজার শাখায় বিশ শতকের তিনের দশকে দুনিয়া জুড়ে দেখা দিয়েছিল ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকট । তার ব্যাপক লাগে তাঁদের পরিবারেও।বউবাজার থেকে তাদের উঠে আসতে হয় দক্ষিণের শহরতলিতে । সুভাষকে ভরতি হতে হয় সত্যভামা ইন্সটিটিউশনে , সপ্তম শ্রেণিতে । এরপর নবম শ্রেণিতে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে । ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আশুতােষ কলেজ ও স্কটিশচার্চ কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেন । পরে দর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ - তে ভরতি হলেও তুমুল রাজনৈতিক ব্যস্ততায় সুভাষের এম.এ পরীক্ষা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি । সত্যভামা ইন্সটিটিউশনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন স্কুল ম্যাগাজিন ফর্মু - তে ছাপা ‘ কথিকাই তার প্রথম প্রকাশিত রচনা । সুভাষের কবিসত্তার প্রকৃত বিকাশ ঘটে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় । এই পত্রিকায় প্রকাশিত সকলের গান ’ ও ‘ রােম্যান্টিক কবিতার সূত্রে ‘ কবিতাভবন ’ - এর আড্ডার আসরে তার যাতায়াত । পরিচিত হন একে একে প্রবােধকুমার সান্যাল , দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় , সমর সেন , অশােক মিত্র , বিষ্ণু দে , অরুণ মিত্রের সঙ্গে । ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কবিতাভবন থেকে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক ' প্রকাশিত হয় । আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলন ’ - এ তাঁর কবিতা স্থান পায় । ১৯৪৮ - এ প্রকাশিত হয় সুভাষের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ অগ্নিকোণ । ১৯৫০ - এ বেরােয় ‘ চিরকুট । পাঁচ ও ছয়ের দশকে একের পর এক প্রকাশিত হয় নাজিম হিকমতের কবিতার বাংলা অনুবাদ , অনূদিত উপন্যাস কত ক্ষুধা ; রােজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ ; অক্ষরে অক্ষরে ; কথার কথা ; দেশবিদেশের রুপকথা , ছােটোদের জন্য সংক্ষেপিত বাঙালির ইতিহাস ; ভূতের বেগার ; যত দূরেই যাই ; কাল মধুমাস ; যখন যেখানে ; ডাকবাংলার ডায়েরি , নারদের ডায়েরি , যেতে যেতে দেখা ; বুশ গল্প সঞ্চয়ন । সর্বোপরি ১১৬১ থেকে ১৯৬৩ - তিন বছর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে ছােটোদের বিখ্যাত সন্দেশ পত্রিকার নবপর্যায়ের সম্পাদনাও।ছয়ের দশক থেকেই তিনি সংযুক্ত থাকেন ‘ আফ্রো - এশিয়ান রাইটার্স । অ্যাসােসিয়েশন ’ - এর বিভিন্ন রকম কাজে । এই সূত্রে পরিচিত হন বিশ্বের খ্যাতনামা কবি ও লেখকদের সঙ্গে । সাতের দশকে এই ভাই ; ছেলে গেছে বনে ; একটু পা চালিয়ে ভাইকাব্যগ্রন্থ ছাড়াও প্রকাশিত হয় স্মরণীয় উপন্যাস হাংরাস ; কে কোথায় যায় । পরের দুই দশকে উল্লেখযােগ্য বই - এর মধ্যে রয়েছে ধর্মের কল ; ফুল ফুটুক , পাবলাে নেরুদার আরাে কবিতা ; হাফিজের কবিতা ; অমর শতক ; গাথা সপ্তশতী অনুবাদ কাব্য , অন্তরীপ বা হ্যানসেনের অসুখ , কাঁচা - পাকা ; কমরেড ; কথা কও উপন্যাস ; আবার ডাকবাংলার ডাকে , ঢােলগােবিন্দর আত্মদর্শন ; ঢােলগােবিন্দর মনে ছিল এই টানাপােড়েনের মাঝখানে , কবিতার বােঝাপড়া প্রবন্ধগ্রন্থ । পরিণত বয়সে সুভাষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় । কমিউনিস্টপাটি এবং ব্যমপন্থী নেতৃবর্গ সম্পর্কে তিনি ক্রমশ আস্থা হারাতে থকেন । কাব্যগ্রন্থেও তার প্রভাব পড়ে এ প্রসঙ্গে যা রে কাগজের নৌকা ’ , ‘ ধর্মের কল ’ , ‘ ছড়ানাে খুঁটি ' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযােগ্য । পদাতিক কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের ৮৪ বছরের দীর্ঘ পথ - হাঁটা শেষ হয়ে যায় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই , মঙ্গলবার , কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিকে , সকাল ৬ টা ৫৫ মিনিটে ।হাত বাড়াও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

Post a Comment

Previous Post Next Post